বিশাল কেওড়া বন, সারি সারি খেজুরগাছের মাঝে মায়াবী হরিণের পদচারণা। এই বনের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে শেষ মাথায় দেখা মেলে পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় হাতিয়ার ‘লালচর’ সমুদ্র সৈকত। বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা ভিড় জমাচ্ছেন এই লালচরে।

এমন অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বুড়িরচর ইউনিয়নে মেঘনার কোল ঘেষে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠেছে ছোট্ট একটি ভূ-খন্ড এম আলী লালচর। প্রকৃতির ভাঙা গড়ার খেলায় এ যেন আরেক বিস্ময়। লাল কাকড়ার অবাদ বিচরণের কারণেই এই চরের নাম হয়েছে ‘লালচর’। এ চরের দৈর্ঘ্য ১০ কিলোমিটার।

জানা যায়, লালচর মূলত একটি ‘চর’। এক সময় এটিকে টান বাজার বাতাইন্নারচর বলা হতো। যা ২০২১ সালে আবিষ্কৃত হয়। এই চরটির একদিকে বাগান আর অপরদিকে সমুদ্র সৈকত। এছাড়াও রয়েছে মায়াবী হরিণ আর গরু-মহিষ ও ভেড়ার পাল। এখানে হাজার পাখির কিচিরমিচির, চিকচিক মরিচিকা হাতছানি দেয় বালুচরে আর এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি খেজুরগাছ, মায়াবী হরিণের পদচারণা, মাইলের পর মাইল সারি সারি কেওড়া গাছ, সমুদ্রের বুকে হেলে পড়ে অস্তগামী রক্তিম সূর্য, সমুদ্রকোল হতে সরু খাল সবুজের বুক চিরে চলে গেছে গহীন বনে। যেন সবুজের গালিচা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে সমুদ্রের তলানী পর্যন্ত।

ঢাকা থেকে ১৬ জন সদস্য নিয়ে লালচরে ঘুরতে এসেছেন মাহফুজুল হক নামের এক চাকরিজীবী। তিনি বলেন, অসম্ভব সুন্দর জায়গা লালচর। এখানে এন্টিনা যুক্ত লাল কাঁকড়া দেখেছি। বিশাল কেওড়া বন দেখেছি। সমুদ্র সৈকত এত দীর্ঘ যে এক পাশ থেকে অন্য পাশ দেখা যায় না। আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।

তাহসিনা আফরোজ নামের এক পর্যটক বলেন, সমুদ্র ভালো লাগে না এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। বিশেষ করে মেয়েরা সমুদ্রে পা ভেজাতে খুব পছন্দ করে। আমি এতো বিশাল সমুদ্র সৈকত দেখে অবাক হয়েছি। এখানে আনন্দ করছি। খুব ভালো লাগছে।

ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে লালচরে ঘুরতে এসেছেন দর্শনার্থী মনির আহমেদ। পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরির সুবাদে কক্সবাজার, কুয়াকাটাসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় ঘুরেছেন তিনি। তিনি বলেন, ব্যস্ত জীবনের পাশ কাটিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে লালচরে এসেছি সময় কাটাতে। আমরা সবাই কক্সবাজার নির্ভরশীল হয়ে যাচ্ছি। উপকূলের দ্বীপগুলোতে পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে।

স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ঘুরতে এসেছেন স্থানীয় বাসিন্দা আতাউর রাব্বি তারেক। তিনি বলেন, মন ভালো করতে মাঝেমধ্যে পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে লালচরে আসি। গত বছর আমরা এখানে জোছনা বিলাসের আয়োজন করেছিলাম। এবারও করব।

৩০০ মানুষের বহর নিয়ে লালচরে বনভোজনে এসেছেন বুড়িরচর ইউনিয়নের ‘অলি উল্যাহ ভূঁইয়ার পরিবার-পরিজন’। আসাদুল্লাহ নামের এক বনভোজনে অংশগ্রহণকারী বলেন, পারিবারিক এই পিকনিককে কেন্দ্র করে ঢাকা থেকে এসেছি। গত বছর এমন আয়োজন নিমতলী সমুদ্র সৈকতে হয়েছিল। এবার লালচরে করা হয়েছে।

লালচরকে পর্যটকবান্ধব করতে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ ২০২১ সাল থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম শুরু করেছে।

বুড়িরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফখরুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিদিন শত শত মানুষ লালচরে আসে। পর্যটকদের সুবিধার্থে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা, ওয়াশরুম, টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। রাস্তার পাশে সৌরবিদ্যুৎ রয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হবে। নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ২০ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবক টিম কাজ করছে।

হাতিয়া উপজেলার চেয়ারম্যান মাহবুব মোর্শেদ লিটন বলেন, পর্যটন শিল্পে অপার সম্ভাবনা রয়েছে এম আলী লালচরে। এর নয়নাভিরাম দৃশ্য যেকোনো পর্যটকের মন কাড়বে। উপজেলা পরিষদ থেকে এটিকে পর্যটকদের সামনে তুলে ধরতে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। রাস্তাঘাট নির্মাণের পাশাপাশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে আরও বাজেট পাওয়া গেলে এটি আরও আকর্ষণীয় করে তোলা যাবে। তাহলে মানুষ লালচরের সৌন্দর্য উপভোগে করতে পারবে।

নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাতিয়া দ্বীপটির আয়তন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানে দেশ ও দেশের বাইরের পর্যটকরা ঘুরতে আসছে। লালচর, নিমতলী সী বিচ, নিঝুম দ্বীপসহ আমরা পুরো দ্বীপকে পর্যটন উপযোগী করতে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। আরও কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা গেলে বেশি মানুষ একত্রে আসতে পারবে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পর্যটকদের আরও সুযোগ-সুবিধার জন্য বলেছি।

Sharing is caring!