দশ মাসে (২০২২-২৩ অর্থ বছরে) খরচ হয়নি ৬৭ শতাংশ, অথবা বলা যায় দশ মাসে খরচ হয়েছে ৩৩ শতাংশ। যদি ১০ মাসের ৩৩ শতাংশ খরচকে আমলে নিতে হয় কোনো বিভাগের পারঙ্গমতা হিসেবে, তবে তা ভয়াবহ।

এই অর্থ বছরে (২০২২-২৩) স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৫.৪ শতাংশ, টাকার অঙ্কে তা ৯,৭৯৪ কোটি। এর মধ্য অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে ৩,২৩৬ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে, ব্যবহারে অপারগ অর্থের পরিমাণ ৬,৫৫৮ কোটি টাকা। এটা এমন নয় যে, অপ্রত্যাশিতভাবে এই বাজেট স্বাস্থ্য বিভাগ বরাদ্দ পেয়েছিল বলে তা ব্যয় করতে পারেনি।

এই বাজেট অনেক অনুশীলনের মাধ্যমে করা হয়ে থাকে। প্রতিটা ক্ষুদ্র ব্যয় নির্বাহ একক থেকে কোড সাব কোড ধরে ধরে হিসাব করে স্বাস্থ্য বিভাগের পুঞ্জীভূত বাজেট প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। এটি একদিকে যেমন সাংবৎসরিক অন্যদিকে তা পঞ্চবার্ষিক এইচপিএনএসপি (HPNSP)-এর অংশ হিসেবেও অনেক আগে থেকেই প্রাক্কলিত থাকে।

এগুলো যেমন একদিকে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিত্তিক তেমনি সেইসব উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যাদি সম্পাদন, মেডিকেল ও সার্জিক্যাল দ্রব্য সামগ্রী এবং যন্ত্র ক্রয়, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিবিধ খরচাদি। আবার বাজেটের একটা বড় অংশ ব্যবহৃত হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি প্রদানে। সুতরাং ব্যয়িত ৩,২৩৬ কোটি টাকার মধ্যে বেতন ভাতাদি বাবদ অর্থ বাদ দিলে খুব সামান্য অংশই স্বাস্থ্য কর্মসূচিগুলোর উদ্দেশ্য-লক্ষ্য অর্জনে সরাসরি ব্যয় করা হয়েছে।

বাজেটের একটা বড় অংশ ব্যবহৃত হয় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি প্রদানে। সুতরাং ব্যয়িত ৩,২৩৬ কোটি টাকার মধ্যে বেতন ভাতাদি বাবদ অর্থ বাদ দিলে খুব সামান্য অংশই স্বাস্থ্য কর্মসূচিগুলোর উদ্দেশ্য-লক্ষ্য অর্জনে সরাসরি ব্যয় করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে যে সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে তার সামগ্রিক প্রভাবে অনেক কিছুই উদ্দিষ্ট পরিমাণ বা সংখ্যায় ক্রয় করা যায়নি। এত স্বল্পাহারে বাজেট ব্যয়ের ফলে স্বাস্থ্য খাতে একটা অজানা আতঙ্কজনক অবস্থা বিরাজ করছে।

স্বল্প বাজেট ব্যয়ের ফলে সব স্বাস্থ্য সেবা সংকুচিত হবে। স্বাস্থ্য সেবায় প্রাত্যহিক ব্যয়ের একটি খাত হচ্ছে হাসপাতালে আসা রোগীদের জন্য ওষুধপত্রাদি এবং পরীক্ষা নিরীক্ষার বাজেট। দেশের সর্বোচ্চ বিশেষায়িত হাসপাতাল থেকে সর্বনিম্ন কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত রোজ লক্ষ লক্ষ রোগী সেবা নেন।

এমনিতেই বেশীরভাগ পরীক্ষা নিরীক্ষা রোগীদের বাইরে থেকে করাতে হয় এবং ওষুধপত্রাদি বাইরে থেকে কিনতে হয়। সেইক্ষেত্রে এই খাতে অর্থ খরচ না করতে পারার ফলে আরও বেশি বেশি পরীক্ষা নিরীক্ষা বাইরে থেকে করাতে হবে, প্রায় কোনো ওষুধই হয়তো পাওয়া যাবে না হাসপাতাল থেকে।

দেশের মানুষের পকেট হতে স্বাস্থ্য সেবায় খরচ প্রায় ৭০ শতাংশ; যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। এই খরচের মূল খাত হচ্ছে বাইরে থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ওষুধপত্রাদি ক্রয়। সহজেই অনুমেয় যে, মানুষের পকেট থেকে খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং এর ধাক্কাটা গিয়ে পড়বে সেই নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষদের ওপর, যাদের বড় একটা অংশ সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। তাদের আর চিকিৎসা বিমুখ না হয়ে উপায়ন্তর নেই। তাহলে কোথায় যাবে আমাদের এসডিজি, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা।

সহজেই অনুমেয় যে, মানুষের পকেট থেকে খরচ আরও বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং এর ধাক্কাটা গিয়ে পড়বে সেই নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীন মানুষদের ওপর, যাদের বড় একটা অংশ সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল।
উন্নয়ন স্বাস্থ্য সেবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিসমূহ। যেগুলোর কর্মকৌশল পাঁচ, দশ বা আরও অধিক বছরের। এতে বিভিন্ন ধারাবাহিক কার্যক্রম থাকে যা ব্যাহত করা যায় না। এখন বেশিরভাগ কর্মসূচি ২০৩০ সাল নাগাদ ব্যাপৃত।

কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া, জলাতঙ্ক, কুষ্ঠ, যক্ষ্মা ইত্যাদি রোগ থেকে মুক্তির অভিপ্রায়ে দীর্ঘমেয়াদি কর্মকৌশল ও কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বাজেট প্রণয়ন করা হয়ে থাকে। কালাজ্বরে কীটনাশক ছেটানো ও নজরদারি, রোগ নির্মূলের জন্য অত্যাবশ্যক। কালাজ্বরপ্রবণ দেশের একশত উপজেলার জন্য কীটনাশক ক্রয় এবং ঘরে ঘরে তা প্রয়োগ অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

এত কম বাজেট ব্যয় অর্থের প্রভাব পড়বে কীটনাশক ক্রয় ও তার প্রয়োগে। অনুরূপভাবে দুই সহস্রাধিক গ্রামে কালাজ্বর নজরদারির জন্য প্রয়োজন ভালো পরিমাণ অর্থের। কালাজ্বর নির্মূলে বাহক নিয়ন্ত্রণ ও রোগ নজরদারি না করা গেলে বা আংশিক করা হলে কালাজ্বর মুক্ত দেশ অধরা থেকে যাবে শুধু তাই নয়, কালাজ্বর পুনরায় উদ্ভব হয়ে সেই আগের কালের কালাজ্বরে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।

আতঙ্কের রোগ জলাতঙ্ক, যাতে শতভাগ মৃত্যু। তা বেড়ে যাবে যদি না ৪-৫ লক্ষ কুকুরে কামড়ের রোগীকে টিকা না দেওয়া যায়। একযুগে জলাতঙ্ক রোগ ৯০ শতাংশ কমেছে, তা আবার বেড়ে যাবে যদি না আমরা দেশের ১৬-১৭ লক্ষ কুকুরকে তিন রাউন্ড টিকা না দিতে পারি।

আরও অনেক রোগের নাম করা যায় যেগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যদি না ব্যয় করা যায়, সেগুলো বাড়বে, পুনরায় উদ্ভব ঘটবে, মৃত্যু বাড়বে। স্বাস্থ্য বিভাগ ব্যবহারে অপারগ হওয়ায়, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে বরাদ্দে কোপ পড়ছে। যা স্বাস্থ্য সেবায় অশনি সংকেত।

বাজেট ব্যয়ে অপারগতা স্বাস্থ্য বিভাগের চিরায়ত রোগে পরিণত হয়েছে, এই রোগ সারানোর কোনো আলোর দিশা দিগন্তে অনুপস্থিত।

অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক

Sharing is caring!