নাসির উদ্দিন শাহ নয়ন ॥ পুরো জেলায় মাদকবিরোধী সভা-সেমিনার ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য আটক এবং এলাকার মসজিদ-মন্দির-গির্জায় মাদক সেবনের কুফল, অপব্যবহার ও মাদক পাচাররোধে জনসাধারণকে সচেতন করার পরও কোনোক্রমেই রোধ করা যাচ্ছে না মাদক সেবন ও পাচার। বরং নিত্য-নতুনভাবে মাদকের থাবায় লীন হচ্ছে স্কুলপড়–য়া ছাত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের মানুষ। এতে মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। এখনই শক্ত হাতে এর লাগাম টেনে না ধরলে ধ্বংস হয়ে যাবে পুরো ছাত্র ও যুবসমাজ। মাদকের বিষাক্ত ছোবলে নাকাল জেলার বিরাট একটি অংশ। মাদক সামগ্রীর এমন কোনো উপাদান নেই যা এ জেলায় পাওয়া যায় না। হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা, ইয়াবা- কি নেই? হাত বাড়ালেই সব পাওয়া যায়। সহজলভ্য এসব উপাদান সরবরাহে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন প্রভাবশালী একটি সিন্ডিকেট। প্রকাশ্য এবং গোপনীয় এমন কিছু স্থান আছে যেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদকের বিরাট একটা চালান এসে মজুদ হয়।
এ বছরের ২৯ মার্চ দেশের প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় (জনকণ্ঠ) মাদক নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এ দেশে কোনো মাদকদ্রব্য উৎপাদন হয় না। অথচ সারাদেশে প্রতিবছর লেনদেন হচ্ছে ৫০ হাজার কোটি টাকার মাদকদ্রব্য। দেশের প্রায় ৬৮ লাখ মাদকাসক্তের জন্য সীমান্ত দিয়ে আসছে ২৪ ধরনের মাদকদ্রব্য। শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই ১১৬ কোটি টাকার মাদকদ্রব্য আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। মাদক বেচাকেনা, চোরাচালান, মাদক নিরাময় কেন্দ্রের বেপরোয়া বাণিজ্য, মাদক প্রতিরোধের নামে আড়াই শতাধিক এনজিওর বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনার মাধ্যমেও মাদক সংক্রান্ত বাণিজ্য হচ্ছে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বছরব্যাপী নানা অভিযান, মামলা পরিচালনাসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড পরিচালনায়ও খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, কেবল গত ফেব্রুয়ারি মাসেই দেশের সীমান্ত এলাকাসহ অন্যান্য স্থানে অভিযান চালিয়ে মোট ১১৬ কোটি ৭৩ লাখ ৭৯ হাজার টাকা মূল্যের বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি’র একটি সূত্রে আরো জানা যায়, বিস্তীর্ণ সীমান্তের ৫১২টি পয়েন্টকে মাদক আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। এসব পয়েন্টে বিজিবির ‘বিশেষ নজরদারি’র মধ্যেও রাত-দিন আসছে ইয়াবা, হেরোইন, আফিম, প্যাথেডিন, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক। বিশেষ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে দেশের সীমান্ত পয়েন্টসমূহে দিনমজুর শ্রেণীর ৩০-৩৫ হাজার লোক মাদক আনা-নেয়ার কাজে জড়িত। সারাদেশে মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরো ২৫ হাজারের বেশি লোক।
দেশজুড়ে মাদক সিন্ডিকেটের ছড়িয়ে থাকা শক্তিশালী জালের মাধ্যমে এসব মাদক ছড়িয়ে পড়ছে পাড়া-মহল্লা আর প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে। তারই ধারাবাহিকতায় নোয়াখালী জেলা শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবাধে অনুপ্রবেশ ঘটছে মাদক উপাদানের। আর এসব মাদক উপাদান নিয়ন্ত্রণকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা বেশ প্রভাবশালী। কথিত এই প্রভাবশালী রথি-মহারথিরা সবসময় থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পুলিশি অভিযানে যারা ধরা পড়েন তারা নেহায়েৎ বহনকারী মাত্র। আর ধৃত ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নিতে কথিত বড় ভাইরা পর্দার আড়াল থেকে দেন-দরবার শুরু করেন। দেড় দশক আগে নোয়াখালীতে শুধু চোলাই মদ আর গাঁজা পাওয়া যেতো। কিন্তু বিবর্তনের ছোঁয়ায় এখানকার মদ্যপায়ীরা এখনো সনাতনী স্বাদ নেবেন কেন? কারণ এখন নিত্যনতুন সব মাদকই তো হাতের নাগালে।
বর্তমানে যুবসমাজের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলছে ইয়াবার নীল থাবা। দিন দিন কাবু হয়ে যাচ্ছে এই জেলার ছাত্র ও যুবসমাজ। জেলার একাধিক এমপি মাদকের বিরুদ্ধে কাঠোর অবস্থানের কথা জানালেও প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় স্থানীয় প্রশাসন শ্যাম রাখি না কুল রাখি অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষ করে নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের এমপি আলহাজ্ব একরামুল করিম চৌধুরী ও জেলা প্রসাশক তন্ময় দাস এবং পুলিশ সুপার মো. আলমগীর হোসেন প্রায় প্রতিটি সভা-সমাবেশে মাদকের বিরুদ্ধে কথা বলে থাকেন।
এদিকে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কোনো কার্যক্রমও চোখে পড়ছে না। ফলে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে ইয়াবা ব্যবসার সিন্ডিকেট। জেলার সচেতন মহল দেশের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে যুবসমাজকে রক্ষায় দলমত নির্বিশেষে দ্রুত মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান চালানোর জোর দাবি জানিয়েছেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, জেলা শহর মাইজদীসহ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বর্তমানে মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যাচ্ছে মরণ নেশা মদ, গাঁজা ও ফেনসিডিল। সাম্প্রতিক সময়ে এ নেশায় যোগ হয়েছে যৌন উত্তেজক ইয়াবা। অল্প পুঁজি, ক্ষুদ্র ট্যাবলেট জাতীয় বলে পরিবহনে সুবিধা হওয়ায় একশ্রেণীর যুবসমাজ ঝুঁকে পড়ছে ইয়াবা ব্যবসার দিকে। আর হাতের কাছেই পাওয়ার কারণে যুবকরা সহজেই ইয়াবা সেবনে আসক্ত হয়ে উঠছে। ফলে নেশার টাকা যোগাড় করতে তারা জড়িয়ে পড়ছে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। আর মাদকের শক্তিশালী এ সিন্ডিকেটের বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণ হয় বৃহত্তর নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্যিক শহর চৌমুহনী থেকে।
তবে দিন দিন জেলায় মাদকের যেভাবে বিস্তার ঘটছে তাতে চিন্তিত অভিভাবকরা। সাধারণত সন্ধ্যার পরপরই মাদক ব্যবসা শুরু হয়। মাদক ব্যবসায়ীরা মোটরসাইকেল নিয়ে পাড়া-মহল্লায় মাদকসেবীদের কাছে ছুটতে দেখা যায়। প্রশাসন একটু উদ্যোগী হলেই মাদক ব্যবসা নির্মূল করা সম্ভব বলে মনে করেন সচেতন মহল।

Sharing is caring!