‘স্বামী মারা গেছে নয় বছর আগে। ২০ বছরের মেয়েকে নিয়ে নগরীর বোষপাড়ায় থাকি। আমার বেতনের টাকায় মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার চলে। তারা (কারখানা কর্তৃপক্ষ) বলেছে রোজার আগে বেতন দেবে, কিন্তু দেয়নি। রোজা শুরু হয়েছে, কষ্ট হয়ে যাচ্ছে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। ইফতার আশপাশের বাড়ির মানুষ দিয়ে যাচ্ছে। কী করব আমাদের তো খাবার কেনার টাকাই নেই, ইফতার কিনে খাওয়া বিলাসিতা ছাড়া কিছু না। এটাই বাস্তব চিত্র। এমন অবস্থা বেতন বন্ধ হওয়া সব শ্রমিকের। কিন্তু কেউ বলতে পারছে না।‘

সাত মাস ধরে বেতন না পাওয়া রাজশাহী রেশম কারখানার টুইস্ট মেশিনে কাজ করা শ্রমিক মোসা. শিল্পী রহমান এভাবেই কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন। গত মাসে বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে আন্দোলন করে রাজশাহী রেশম কারখানার শ্রমিকেরা। তবে কয়েকদিনের মাথায় হঠাৎই চুপসে যায় সেই আন্দোলন। কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে বেতনের দাবিতে করা আন্দোলন থামিয়ে শ্রমিকরা কাজে ফেরেন। এতে রেশম কারখানা সচল হলেও এখনো থেমে আছে শ্রমিকদের বেতন।

শ্রমিকরা বলেন, আন্দোলন চালাকলীন কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে কাজে ফিরে যান শ্রমিকরা। সেই সময় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল রমজানের আগেই আমাদের বেতন দেওয়া হবে। কিন্তু রমজান মাস শুরু হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দেওয়া আশ্বাসের একমাসও কেটে গেছে। তবুও বেতন পায়নি শ্রমিকরা।

শিল্পী রহমান আরও বলেন, মেয়ে এইচএসসি পাস করেছে। তাকে অর্নাসে ভর্তি করাতে হবে। আগামী মাসের নয় তারিখের মধ্যে ভর্তির কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। কিন্তু ঘরে কোনো টাকা নেই। যা জমানো ছিল তাও সাত মাসে শেষ হয়ে গেছে। বেতন না পেলে মেয়েকে ভর্তি করা সম্ভব হবে না। এর মধ্যে সামনে ঈদ কী করবো বুঝে পাচ্ছি না।

আরেক শ্রমিক খাইরুল ইসলাম বলেন, মানুষের থেকে ধার চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। শুনেছিলাম রজমান মাসের আগেই বেতন দেবে। কিন্তু দিল না। রোজা শুরু হয়েছে, রোজা করছি। ইফতারে ভাত বা রুটি খাচ্ছি। ইফতার কেনার টাকা নেই। কীভাবে কিনে খাব। মানুষ কতদিন বিনা বেতনে চলতে পারে? আপনিই বলেন। যেখানে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।

তিনি আরও বলেন, এই কারখানায় ৪০ জন শ্রমিক নিয়মিত কাজ করতেন। কিন্তু বেতন বন্ধের পরে অনেক শ্রমিক কমে গেছে। বেতন না পাওয়া, কাছে যাতায়াত ভাড়া না থাকা ছাড়াও বিভিন্ন সঙ্কটের কারণে এখন কারখানায় আসছেন মাত্র পাঁচজন শ্রমিক। তাদের মধ্যে আছেন, পবার নওহাটার রোজি, নগরীর সিএনবির মোড় এলাকার মুকুল, মো. নিতু ইসলাম, মনিকা ও সাথী। তারা জীবিকার তাগিদে এখন বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছেন।

এদের মধ্যে একজন মো. নিতু ইসলাম। তিনি বলেন, এর আগে আমাদের আশ্বাস দিয়ে আন্দোলন তুলে দরখাস্ত দিতে বলে। আমরা আন্দোলন তুলে নিয়ে দরখাস্ত দেই। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। আমাদের যে হাজিরা খাতা ছিল সেটা কর্তৃপক্ষ নিয়ে নিয়েছে। এখন অন্য একটা খাতায় হাজিরা নিচ্ছে। জানি না কবে বেতন পাব। আমাদের তো চলতে হবে। কোন জায়গায় কাজ না করলে পরিবার নিয়ে চলা সম্ভব না। বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির বিল, সন্তানের লেখাপাড়া ছাড়াও সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সংসার চালানোর জন্য রাজশাহী আরডিএ মার্কেটে কাপড়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজে লেগেছি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শ্রমিক জানায়, তারা দৈনিক মুজুরি ভিত্তিক শ্রমিক। আন্দোলনের ফলে যদি কাজ চলে যায়। এমন চিন্তা থেকে এই শ্রমিকরা কাজে ফিরেছেন। এছাড়াও তাদের আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল রমজান মাসের আগেই বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। কিন্তু সেটা করেনি কর্তৃপক্ষ। রমজান মাসে কষ্টে আছে সবাই। যেখানে খাবার কিনে খেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সেখানে ইফতার কিনে খাওয়া তাদের কাছে এক ধরনের বিলাসিতা।

এ বিষয়ে আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক কাজী মাসুদ রেজা বলেন, ‘আমাদের রেশম কারখানার চেয়ে বেশি বাংলাদেশের রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বারেগপ্রই) শ্রমিক। তারা ১৫৭ জন। আর কারখানার শ্রমিক ৪০ জন। সব শ্রমিকদের বেতন বাকি রয়েছে। কর্তৃপক্ষের কথা বারেগপ্রই ও কারখানার শ্রমিকদের একসঙ্গে বেতন দেওয়া হবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে বেতন হতে পারে শ্রমিকদের।’

বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রসারণ বিভাগ পরিচালক (সম্প্রসারণ) মোহাম্মদ এমদাদুল বারী বলেন, ‘বেতন বন্ধ রয়েছে বারেগপ্রই ও রেশম কারখানার শ্রমিকদের। এরমধ্যে গবেষণাগারের ১৫৭ জন শ্রমিক রয়েছেন। শ্রমিকদের গত তিন মাসের বেতন দেওয়া হবে। আগামি কয়েকদিনের মধ্যে তাদের বেতন হতে যেতে পারে।’

প্রসঙ্গত, গত ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশের রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের শ্রমিকরা ৭ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে মানববন্ধন করে। বারেগপ্রই এর ১৫৭ জন শ্রমিকের বেতন বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত এই শ্রমিকদের নয় মাসের বেতন বন্ধ রয়েছে। বারেগপ্রই শ্রমিকদের আন্দোলনের পরে গত ২২ ফেব্রুয়ারি ৬ মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করে রাজশাহী রেশম কারখানার শ্রমিকরা। এই ৪০ জন শ্রমিকের বর্তমানে সাত মাসের বেতন বাকি রয়েছে।

Sharing is caring!