কঠোর গোপনীয়তায় গ্রেফতারের মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় জামিনে মুক্ত হয়েছেন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। মিরপুর-পল্লবী এলাকার আতঙ্ক এই মফিজুর রহমান মামুন কারাগার থেকে বের হয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সবাইকে অন্ধকারে রেখে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। আশ্রয় নিয়েছেন সেই আগের ঠিকানায়। মামুনের আপন বড় ভাই মজিবর রহমান জামিল এবং ছোট ভাই মশিউর রহমান মশুর কাছে। তবে ২৭টি মামলার মধ্যে ১৫টি গ্রেফতারি পরোয়ানা, একটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির কারা মুক্তিতে রীতিমতো হতবাক খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাই। তবে কারা কর্তৃপক্ষ বলছে, কারাগারে অন্য কোনো মামলার কাগজ না যাওয়ায় তারা মামুনকে মুক্তি দিতে বাধ্য ছিলেন।

সূত্র বলছে, মামুনের আপন বড় ভাই মজিবর রহমান জামিল। পলাতক আরেক হেভিওয়েট সন্ত্রাসী। ছোট ভাই মশিউর রহমান মশু গাজীপুরের সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ হত্যা মামলার ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। তিন ভাই মিলে দীর্ঘদিন ধরে ভারতে অবস্থান করে মিরপুরের আন্ডারওয়ার্ল্ডের বড় একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। গ্রেফতারের পর ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রেস রিলিজে উল্লেখ করা হয়েছিল, আটক ব্যক্তি শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন মর্মে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, খুন, মাদক, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ডাকাতির অভিযোগে পল্লবী থানায় ২৭টি মামলা, ১৫টি গ্রেফতারি পরোয়ানা ও দুটি সাজা পরোয়ানার তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনের বিষয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে, মামুনের মুক্তির বিষয়ে কাশিমপুর-১ এর সিনিয়র জেল সুপার গিয়াস উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কাছে সিটিটিসির একটি সাধারণ ডায়েরি এবং ৩০২ ধারার একটি মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ছিল। পরে ২৩ মার্চ অতিরিক্ত দায়রা জজ চতুর্থ আদালতের জামিন আদেশ মূলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে মামুনের বিষয়ে আমাদের কাছে অন্য কোনো মামলার কাগজপত্র ছিল না। তবে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী ওয়াজেদ আলী গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মামুনের বিরুদ্ধে ১৫টি ওয়ারেন্ট ছিল। এর মধ্যে দুটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজার পরোয়ানা। থানায় কাগজপত্র পর্যালোচনা করে তিনি বলেন, ২০০৫ সালে ৫ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় দায়েরকৃত মামলায় তার ৫ বছরের জেল, ২০০৭ সালের ১০ অক্টোবর পল্লবী থানার দায়েরকৃত মামলায় যাবজ্জীবন এবং পল্লবী থানায় দায়েরকৃত ১৯৯৬ সালের ৬ এপ্রিল দায়েরকৃত মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি মামুন। অন্যদিকে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনার ক্রাইমের একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, পল্লবী থানায় বোমা হামলার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই মামুনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। এ সময় মামুনের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর, মিরপুর এবং পল্লবীতে মোট ২৭টি মামলার খবর আমরা পেয়েছিলাম। এর মধ্যে ১৫টি মামলার ওয়ারেন্ট ছিল। রিমান্ডে মামুনই আমাদের জানিয়েছিল তিনি দীর্ঘদিন বিদেশে পলাতক থাকার কারণে তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অনেক মামলার খবরই তিনি জানেন না। তবে তিনি যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এটা তিনি জানেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুই সহোদর জামিল এবং মশুকে নিয়ে ভারতে বসেই মিরপুর-পল্লবী এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের পুরোটা নিজেদের কব্জায় নেওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। তবে বড় ভাই জামিল, ছোট ভাই মশুকে নিয়ে তৈরি করা ছকের বিষয়টি আঁচ করতে পারে ভারতে অবস্থানরত আরেক পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে উল্টো ‘লেদার লিটনের’ মধ্যস্থতায় তাদের তিন ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক দফা নেপালে বৈঠকও করে। বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে মামুনের জন্য কয়েকটি কাজে ফোনও দেয় ওই সন্ত্রাসী। সর্বশেষ ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর পরামর্শেই মামুন ঢাকায় আসে এক রাজনৈতিক নেতাকে কিলিংয়ের মিশন নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন, ওই সন্ত্রাসীর ফাঁদে পা দেওয়াই কাল হয় মামুনের। তবে গ্রেফতার হলেও একটি প্রভাবশালী মহলের মধ্যস্থতায় মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে মাত্র ৪৫ দিনের মাথায় জামিনে মুক্ত হয় সবাইকে অন্ধকারে রেখে। এতদিন ধরে বিষয়টি গোপন রাখা হয়। তবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে এই খবরটি আসলে কারা কর্তৃপক্ষকে জানালে তারাও বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে ৭ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার, ১৩ ফেব্রুয়ারি কারাগারে পাঠানো, ১৯ ফেব্রুয়ারি কাশিমপুর-১ এ স্থানান্তর এবং সর্বশেষ ২৪ মার্চ মুক্ত হওয়ার তথ্যটি সুনির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করা হলে সিনিয়র জেল সুপার প্রায় এক ঘণ্টা পর এ প্রতিবেদককে তার অফিশিয়াল বক্তব্য দেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৪ সালে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ত্রিপুরায় ক্ষমতাসীন এক এমএলএ’র ভাইয়ের আশ্রয়ে ছিলেন বেশ কিছুদিন। ওই ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মামুনের। ওই বাড়িতে দীর্ঘদিন আশ্রয়ে থাকার কারণে ওই ব্যক্তির বোনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মামুনের। একপর্যায়ে গোপনে তারা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন। ভারতীয় পরিচয় নিয়ে একটি পাসপোর্টও তৈরি করে। ওই পাসপোর্ট দিয়ে  সে নিয়মিত ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও নেপাল ভ্রমণ করে। তবে কিছুদিন পর বিয়ের বিষয়টি আঁচ করতে পারার পর মামুনকে অবৈধ অনুপ্রবেশসহ আরেকটি অপরাধের সংশ্লিষ্টতা দেখিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলে অবস্থান করলেও মামুন তার ভাইদের মাধ্যমে ঢাকায় অপরাধ কর্মকান্ড অব্যাহত রাখেন। মামুনের হয়ে তার অপরাধ সাম্রাজ্যের তদারকি করতেন কিবরিয়া, মাসুদ, তার শ্যালক লাভলু। মোবাইল ফোনে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে চাঁদা চেয়ে হুমকি দিতেন মামুন। প্রাণ বাঁচাতে ব্যবসায়ী, বাড়ির মালিক, কাউন্সিলর, এমনকি মাদককারবারিরও তার লোকদের হাতে চাঁদা তুলে দিতেন। অন্যথায় টার্গেট ব্যক্তিকে খুন করিয়ে  ফেলতেন মামুন। ২০১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের জেল থেকে মুক্ত হয়ে তার সেই আশ্রয়দাতা বন্ধুর ওপরই হামলা চালান মামুন। পালিয়ে যান নেপাল। আশ্রয় নেন ধানমন্ডি-হাজারীবাগ এলাকার পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী লেদার লিটনের কাছে। সর্বশেষ গত ২৪ মার্চ জেল থেকে বেরিয়ে মামুন নিয়মিতভাবে তার ভাগ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ফোন করেন মিরপুর এলাকার এক তরুণ কাউন্সিলরের ডান হাত বিহারি ক্যাম্পসহ মিরপুরের অন্যতম মাদক কারবারি আড্ডুকে। মামুনের মধ্যস্থতায়ই জার্সি বাহিনীর প্রধান আড্ডু এখন মাদক, ফুটপাথ এবং অটোরিকশার চাঁদার অংশ আরও দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর ডেরায় নিয়মিতভাবে পৌঁছানো হচ্ছে।

যেভাবে উত্থান : এক সময়ের ফেনসিডিলের স্বর্গ হিসেবে চিহ্নিত ছিল পল্লবীর ধ-ব্লক ও সাংবাদিক কলোনি এলাকা। এখানকার মাদক সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ছিলেন মামুন। মিরপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম, সাহাদাত, তাজগীরের রামরাজত্বের মধ্যেই নাটকীয় উত্থান ঘটে মামুনের। মিরপুরের পল্লবী থানাধীন ধ-ব্লকের বাসিন্দা মামুন ১৯৯৫ সালেও ছিঁচকে চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত ছিলেন এলাকায়। শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠার নাটকীয় ঘটনাটি ঘটে ২০০২ সালে। সে সময় পুলিশের হাতে আটক এক মাদককারবারিকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় পল্লবী থানায় সশস্ত্র হামলা চালান মামুন ও তার বাহিনী। প্রায় ২ ঘণ্টা বন্দুকযুদ্ধের পর অস্ত্রসহ ধরা পড়েন মামুন। দুই পক্ষের  গোলাগুলিতে আহত হন তার এক সহযোগী। বছরখানেক কারাভোগের পর বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতার যোগসাজশে এক দিনে সাতটি মামলায় জামিন নিয়ে ২০০৪ সালে তিনি পাড়ি জমান ভারতে। চাঁদা না পেয়ে ২০০৮ সালে পল্লবীতে নজরুল ইসলাম চৌধুরী মন্টু নামে এক ঝুট ব্যবসায়ীকে খুন করার মামলায় অন্যতম আসামি মামুন। ২০১২ সালে তার বাহিনীর হাতে খুন হন গার্মেন্ট কাপড় ব্যবসায়ী রমজান। এ হত্যা মামলায় মামুনকে প্রধান আসামি হিসেবে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৬  থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মামুনের বিরুদ্ধে পল্লবী ও মোহাম্মদপুর থানায় হত্যা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা হয়। সন্ত্রাসী মামুন ও তার বাহিনী সর্বশেষ আলোচনায় আসেন পল্লবী-১২ নম্বও সেকশনের বি-ব্লকে ৯/২ নম্বর সড়কের ১৫২/১৬ নম্বর বাড়িটি দখলের মধ্য দিয়ে। এ নিয়ে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন পল্লবীর ভুক্তভোগীরা। এ ছাড়া, গত বছরের ২৯ জুলাই ভোরের ওই ঘটনায় চার পুলিশসহ পাঁচজন আহত হন। এর পর পল্লবীতে অস্ত্রসহ তিন যুবককে গ্রেফতারের পর  বেরিয়ে আসে মামুনের সংশ্লিষ্টতার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। জানা গেছে, বর্তমানে মামুনের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে এলাকায় গোপনে সক্রিয় মাসুদ। মূলত ইয়াবা ব্যবসার দেখভাল করছে মাসুদ। ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে কিবরিয়া, মাইজ্যা দুলাল। লরেন ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। মিরপুর এলাকায় তার অন্তত কয়েক ডজন সহযোগী রয়েছে। চাঁদার টাকা তুলে তারাই মামুনের কাছে পাঠাত। গত বছর পল্লবী এলাকার দুই রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার জন্য ভাড়ায় খাটছিলেন গ্রেফতার রফিকুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম ও মোশাররফ হোসেন। তাদের প্রত্যেকেই মামুন-জামিলের অন্যতম ক্যাডার।

ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা, স্ত্রী-সন্তান অস্ট্রেলিয়ায় : পলাতক  থেকেও ঢাকায় পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে আসছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন। রবরব পরিবহনে তার ১০টির মতো বাস চলছে। রয়েছে একাধিক বাড়িও। ব্যবসা ও চাঁদাবাজি থেকে মামুনের মাসে অর্ধকোটি টাকা আয় ছিল বলে সিটিটিসির জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন। এমনকি তিনি অর্থ দিয়ে মিরপুর এলাকার প্রয়াত বিএনপি নেতা আহমাদ হাসানের মাধ্যমে ৯১ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতির পদও বাগিয়ে নিয়েছিলেন। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুন চাঁদাবাজির টাকায় দুই সন্তানকে অস্ট্রেলিয়ায় পড়িয়েছেন। তার মেয়ে তাসনিম রহমান ও ছেলে রেদোয়ান আহমেদ দুজনই অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। স্ত্রী রীনাও মাঝে মধ্যেই ঢাকা-অস্ট্রেলিয়া যাতায়াত করেন। তবে রীনা বর্তমানে ঢাকায় অবস্থান করছেন।

Sharing is caring!