মোঃ সেলিম:

নিখোঁজের ৯ বছর পর নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার এক তরুণীকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকেলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক তন্ময় দাস আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে তার বাবা মায়ের কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় নিখোঁজের পিতা মাতা এবং চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি ও জেলায় কর্মরত সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন।

( ঘটনা শুরু যেভাবে ) ১৯ বছরের তরুণী শিরিন আক্তার সেলিনা, নোয়াখালী জেলার দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মেয়ে। বাবা পেশায়
একজন জেলে। মা গৃহিনী। ৪ বোন ২ ভাই নিয়ে তাদের সংসার। আজ থেকে ৯ বছর আগে বাবা প্রতিদিনের মতো সাগরে মাছ ধরতে যান। সাগরের মাঝখানে তিনিসহ অপরাপর জেলেরা ডাকাতের কবলে পড়েন। সবার মতো শিরিনের বাবাও নিখোঁজ ছিলেন প্রায় ৮ দিন। এরমধ্যেই ঘটে শিরিন ট্রাজেডি। শিরিন থাকতো তার নানীর কাছে (বেড়াতে যাওয়ার সূত্রে)। নানীর অসুস্থতার কারণে তাঁর সাথেই ছিল শিরিন। জেঠাসহ আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে নানানভাবে শিরিন জানতে পারে তার বাবা নিখোঁজ, সবাই বলতে থাকে ডাকাতের দল তার বাবাকে মেরে ফেলেছে। আর সেই কারণে মা স্ট্রোক করে মারা গেছে। ছোট্ট শিরিন নিজেকে খুব অসহায় মনে করে কান্নাকাটি করে। এরমধ্যেই বড় জেঠার সাথে নানীর চিকিৎসার জন্য নোয়াখালী সদর হাসপাতালে যায় শিরিন। হাসপাতালে নানীর চিকিৎসা করানো অবস্থায় শিরিন হারিয়ে ফেলে তার নানী ও জেঠাকে। কান্নাকাটির এক পর্যায়ে অপরিচিত এক নারীর খপ্পরে পড়ে শিরিন। নারীর প্রশ্নের জবাবে শিরিন তার বাবা-মায়ের মৃত্যুর কথা জানায়। এরপর ওই নারী শিরিনকে তার নানীর কাছে পৌঁছে দেয়ার কথা বলে নিয়ে যায় চট্টগ্রামের হালিশহরে। সেখানে একটি বাসায় নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে শিরিনকে একটি বাসায় কাজের মেয়ে হিসেবে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে চলে যান সেই নারী। অনেক কান্নাকাটির পর শিরিন বাবা-মায়ের মৃত্যুর কারনে অসহায়ত্ব মেনে নিয়ে কাজ করতে থাকে সেই বাসায়। কিছুদিনের মধ্যেই কারণে, অকারণে, একটু ভুল হলেই অকথ্য নির্যাতন শুরু করে বাসার লোকজন। এমনকি তাদের সন্তানরাও শিরিনকে নানানভাবে শারিরীক নির্যাতন করতো।

এভাবে প্রায় ৩ বছর সেই বাড়িতে থাকাবস্থায় শরীরে নির্যাতনের বহু ক্ষত নিয়ে পালিয়ে আসে শিরিন। সারাদিন অভুক্ত কিশোরী শিরিনের তখন বয়স মাত্র ১৩ বছর। ১০ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া শিরিন ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই বাসা থেকে পালিয়ে যায়। নানান জনের কাছে সাহায্য চেয়েও পায়নি সে কোন সাহায্য। এক পর্যায়ে রাতে সন্দ্বীপের অধিবাসী হালিশহরের স্বপ্না বেগমের বাসায় যায় শিরিন। কান্নাকাটি করে শুধুমাত্র রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার আকুতি জানায়। কোমল হৃদয়ের স্বপ্না এক পর্যায়ে কিছু না ভেবেই মানবিক কারণে সেই রাতে শিরিনকে আশ্রয় দেয়। পরের দিন স্বপ্না বেগমের পরিবার স্বপ্নার সাথে এই বিষয়ে অশান্তির সৃষ্টি করে। তাদের মতে, জানা নাই, পরিচয় নাই- এমন একটি মেয়েকে ঘরে কাউকে না জানিয়ে রাখাটা বিপদ ডেকে আনা। স্বপ্না শিরিনের বিষয়টি সবাইকে বোঝায় এবং তার শারিরীক অবস্থার বিষয়টি অবগত করে। সারা শরীরে অকথ্য নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে থাকা শিরিনকে স্বপ্না বেগমের পরিবারের সিদ্ধান্ত মতে স্থানীয় থানায় নিয়ে যাওয়া হয় শিরিনকে। করা হয় সাধারণ ডায়েরি। এরপর থানা কর্তৃপক্ষের অনুরোধ এবং অসুস্থ শিরিনের অবস্থার কথা বিবেচনা করে শিরিনকে স্বপ্না বেগম নিয়ে আসেন নিজের ঘরে। এভাবে দুই-তিনদিন থাকার পর স্বপ্নার বড় বোন সানোয়ারা বেগম (৪৫) ও তাঁর স্বামী দিদারুল আলম শিরিনকে মানবিক কারণে নিজের বাড়িতে (আকবরশাহ থানাধীন বিশ্ব কলোনীতে) নিয়ে যান। সেই থেকে নিজের মেয়ের মতোই শিরিনকে পড়ালেখা করানো থেকে শুরু করে সব কিছুই করেছেন তিনি তাকে বড় করেছেন খুবই যত্নের সাথে। গত জুন মাসে মহা ধুমধাম করে নিজের পেটের মেয়ের মত করেই শিরিনকে বিয়ে দেন তারা।

দীর্ঘ এই সময়ে তারাও চেষ্টা করেছেন শিরিনের পিতৃপরিচয় এবং তার পরিবারকে খুঁজে পেতে। ব্যর্থ হয়ে সেই আশা ছেড়ে দেন তারা। শিরিন তাদের মেয়ে হিসেবেই জীবন-যাপন করতে থাকে। অন্যদিকে শিরিনের প্রকৃত বাবা-মাও কয়েকদিন মেয়েকে খুঁজে ফিরেছেন বহু জায়গায়। তবে শিরিনের আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিদের মতে- শিরিন হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে, হয়তো সে আর বেঁচে নেই- এমন সব কথার কারণেই এক পর্যায়ে শিরিনকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দেন তার বাবা-মা। শিরিন নিখোঁজের ৪ দিন পর তার বাবা ডাকাতের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাড়ি ফেরেন। সবকিছু মিলিয়ে শিরিনদের সংসারে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এদিকে একটি সংবাদ পরিবেশনের সূত্র ধরে সেই পরিবারটি গত জুন মাসের শুরুর দিকে আসেন চট্টগ্রামে সুবিধাবি শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জীবনমান উন্নয়ন ও পুনর্বাসনে কর্মরত জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগঠন ভোরের আলো’র অফিসে। প্রতিষ্ঠানটির সহযোগি প্রতিষ্ঠান মাসিক কাট্টলী বার্তায় একটি সংবাদের কারণে তাদের এই অফিসে আসা। সেটি সমাধানের এক পর্যায়ে কাট্টলী বার্তা’র প্রধান সম্পাদক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগঠন ভোরের আলো’র প্রতিষ্ঠাতা মো. শফিকুল ইসলাম খানকে শিরিনের বিষয়টি অবগত করেন এবং তার পরিবারকে একটু খুঁজে দেয়ার অনুরোধ করেন সানোয়ারা-দিদারুল আলম দম্পত্তি। প্রথম দিকে বিষয়টিতে তেমন গুরুত্ব না দিলেও শফিকুল ইসলাম খান যেহেতু শিশু-কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে কাজ করেন, তিনি শিরিনের পরিবারকে খুঁজে পেতে কাজ শুরু করেন। গত ২৬ জুন তিনি নোয়াখালীর হাতিয়ায় জাতীয় দৈনিক খোলা কাগজের স্টাফ রিপোর্টার সাইফুল ইসলাম মাছুমকে অনুরোধ করেন এই বিষয়ে। এছাড়াও মাসিক কাট্টলী বার্তা ও ভোরের আলো শিরিনের পরিবারকে খুঁজে বের করার নানান প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। প্রায় ১ মাস পর আগস্টে ভোরের আলো’র প্রতিষ্ঠাতা উন্নয়ন কর্মী, সংগঠক ও সাংবাদিক মো. শফিকুল ইসলাম খান হাতিয়ায় শিরিনের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। স্থানীয় প্রবীণ সাংবাদিক জনাব মোস্তফা সাহেব স্থানীয়দের মাধ্যমে জানতে পারেন শিরিনের বাবা- মা ও অন্যান্য ভাই-বোনেরা সবাই বেঁচে আছেন। এরপরই শিরিনের পরিবার অর্থাৎ বাবা আবুল কাসেম (৪৭) এবং মা ফাতেমা খাতুন (৪২) কে চট্টগ্রামে ভোরের আলো অফিসে ডাকা হয়। তাদের কাছে থাকা শিরিনের (প্রকৃত নাম সেলিনা আকতার) ছবি ও জন্ম নিবন্ধন কপি পাওয়া যায় যা সঠিক হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়াও শিরিনও তার বাবা-মাকে চিনতে পারেন।

নানান আইনী প্রক্রিয়া অনুসরণের অংশ হিসেবে পৃথকভাবে শিরিনকে লালন-পালনকারী পরিবার, শিরিনের শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীকে, শিরিনের প্রকৃত মা-বাবাকে নোয়াখালী থেকে ভোরের আলো অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। সব কাগজপত্র ও প্রমাণাধির সমীকরণ মিলিয়ে প্রমাণ হয় শিরিনের মা-বাবা তারাই। দীর্ঘ ৯ বছর বাবা-মায়ের হারিয়ে যাওয়া কিশোরী (বর্তমানে তরুণী) শিরিন আক্তার সেলিনাকে তার প্রকৃত মা-বাবার হাতে তুলে দেয়ার সন্ধিক্ষণে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ।

Sharing is caring!