আল জিহাদ ॥ মাশরাফিকে আদর্শ মেনে পথচলা তরুণদের সংখ্যা এদেশে কম নেই। তবে তাদের মধ্যে থেকে কেউ অকালে ঝরে পড়েন, আবার কেউ নিজের সামর্থ্যরে শতভাগ উজাড় করে দিয়ে খেলে যান নিয়মিত। তেমনই একজন পেসারের নাম ইয়াসিন আরাফাত মিশু। তিনি জেলা শহর মাইজদীর পশ্চিম রাজারামপুর গ্রামের মো. নুরুল আমিনের ছেলে। মিশুরা তিন ভাই এক বোন। বোন সবার বড়। মিশু পিতা-মাতার দ্বিতীয় সন্তান। ১৯ বছর বয়সী এই তরুণ পেসারকেও ইনজুরিতে পড়তে হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু মাশরাফির মতোই ইনজুরি তাকে কখনো পিছু হটতে দেয়নি। ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি ছিল মিশুর প্রচণ্ড ঝোঁক। পড়া ফাঁকি দিয়েও ক্রিকেট খেলতে চলে যেতেন মাঠে। মিশুর ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ দেখে তার বাবা-মাকে সাভারের বিকেএসপিতে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন গৃহশিক্ষক। মূলত গৃহশিক্ষকের পরামর্শেই পরবর্তীতে বিকেএসপিতে ভর্তি করা হয় মিশুকে। আর সেখানে ভর্তি হয়েই নিজের জাত চেনান তরুণ এই প্রতিভাবান পেসার। বয়সভিত্তিক ক্রিকেট দলের হয়ে খেলার সুযোগ এখান থেকেই হয় মিশুর। আর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করে ছোট থেকে লালন করা স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তেও চলে যান তিনি। সুযোগ আসে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলার। কিন্তু গত বিশ্বকাপের ঠিক আগে ইনজুরিতে পড়ে সেই স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায় তার। সে সময়েই হয়তো দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নতুন উদ্যমে ফিরে আসার। ঠিক যেভাবে বারবার ফিরে এসেছেন মাশরাফি-বিন-মর্তুজা। যার সর্বশেষ উদাহরণ দেখা গিয়েছে চলমান ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের (ডিপিএল) আসরে। ইনজুরি থেকে ফিরে গাজি গ্রুপের হয়ে খেলা অমিত সম্ভাবনার এই তরুণ প্রবল প্রতিপক্ষ আবাহনীকে রীতিমত একাই ধসিয়ে দিয়েছেন।
নাসির, মাশরাফিদের বিপক্ষে ৪০ রানে একাই ৮ উইকেট শিকার করেন এই উঠতি তরুণ। আর তার এই বিধ্বংসী স্পেলে মাত্র ১১৩ রানে গুটিয়ে যায় শক্তিশালী আবাহনী। আর এই ম্যাচ দিয়ে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ৮ উইকেট শিকার করার বিরল রেকর্ড গড়লেন ১৯ বছর বয়সী মিশু।
শুধু তাই নয়, বিশ্বক্রিকেটের অষ্টম সেরা বোলিং ফিগারের মালিকও বনে গিয়েছেন তিনি। আর তার এই পারফর্মেন্সে যে মাশরাফিই ছিলেন মূল প্রেরণা তা বলাবাহুল্য। মিশুর কথাতেই তাই ফুটে উঠলো মাশরাফিস্তুতি। নিজের রোল মডেলকে নিয়ে তিনি বলছিলেন, আমার রোল মডেল হলেন মাশরাফি ভাই। আমি ভাবি, উনি দুই হাঁটুতে সাতটা অপারেশন নিয়েও যতো সুন্দর খেলছেন, আমি কেন পারবো না। ওনার তুলনায় আমার ইনজুরিতো কিছু না। আমি ওনাকে দেখেই স্বপ্ন দেখি। মূলতঃ কোচ সালাউদ্দিনের কথা অনুযায়ী বোলিং করেই সাফল্য পেয়েছেন মিশু। তার ওপর উইকেটও ছিল বোলিং সহায়ক। ফলে এর ফলাফলটি ভালোভাবেই পেয়েছেন তিনি। মিশু বলেন, উইকেট খুব বোলিং সহায়ক ছিল। আমরা টসে জিতে ফিল্ডিং নিয়েছিলাম। আমি বাড়তি কিছু করিনি। স্যার যেমন বলেছেন, জায়গায় বল করা এবং ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা মাথায় রেখে বল করা, সেটা করেছি। ভালো বোলিংয়ের ফল পেয়েছি। মিশুর মতো প্রতিভাবান পেসাররা যেন অকালে হারিয়ে না যান এর জন্য এগিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকেই। দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা এগিয়ে আসলেই শুধুমাত্র বাংলাদেশ দল হয়তো আরেকজন স্পিডস্টার উপহার পাবে ভবিষ্যতে।
জিম্বাবুয়ে ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় সিরিজের প্রথম দুটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচের জন্য সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) ঘোষিত ১৩ সদস্যের বাংলাদেশ দলে চমক দেখিয়ে জায়গা করে নিয়েছেন ইয়াসিন আরাফাত মিশু। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের যে কোনো ফরম্যাটের মূল দলে ডাক পেয়েছেন মাত্র ১৯ বছর বয়সী মিশু। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এই ডানহাতি পেসার গেল এক বছরের বেশি সময় ধরেই জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে ছিলেন। ২০১৮ সালের জুনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে ঘোষিত বাংলাদেশের ৩১ সদস্যের প্রাথমিক স্কোয়াডে ছিলেন মিশু। এছাড়া গেল মাসে ৩৫ ক্রিকেটারকে নিয়ে চারদিনের যে কন্ডিশনিং ক্যাম্প করেছিল বিসিবি, সেখানেও ছিলেন তিনি। টি-টোয়েন্টি দলে মিশুর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি অবশ্য বেশ চমক হয়েই এসেছে। কারণ এখন পর্যন্ত ঘরোয়া পর্যায়ে কোনো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেননি তিনি। আগের বছরটায় চোটের সঙ্গে বেশ লড়াই করতে হয়েছে মিশুকে। তাই চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ টি-টোয়েন্টিতে খেলা হয়নি তার। চোট কাটিয়ে মাঠে ফেরার পর গেল জুলাইতে একটি লিস্ট ‘এ’ ম্যাচে আফগানিস্তান ‘এ’ দলকে হারানোতে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের হয়ে ৩ উইকেট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মিশু। এরপর বাংলাদেশ হাইপারফরম্যান্স দলের হয়ে শ্রীলঙ্কা ইমার্জিংয়ের বিপক্ষে সিরিজে অবশ্য আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারেননি তিনি। তবে ক্যারিয়ার শুরুর অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথমশ্রেণি ও লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে মিশু নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর ও সামর্থের প্রমাণ রেখেছেন। তাছাড়া আগামী বছর অনুষ্ঠিত হবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। তাই সব দিক বিবেচনা করে দারুণ সম্ভাবনাময় মিশুকে পরখ করে দেখতে চাইছেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু। দীর্ঘদেহী মিশু উইকেট থেকে বেশ বাউন্স আদায় করে নিতে পারেন। আর উইকেট সুবিধা না দিলে তার লক্ষ্য থাকে ব্যাটসম্যানের খেলার ধরন বুঝে ডেলিভারি দিয়ে তাকে পরাস্ত করা। গেল বছর মার্চে মিশু হইচই ফেলে দিয়েছিলেন লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে রেকর্ড বোলিংয়ের নজির তৈরি করে। মোসাদ্দেক-নাসির-শান্ত-মাশরাফিদের নিয়ে গড়া আবাহনী লিমিটেডের বিপক্ষে ৪০ রানে নিয়েছিলেন ৮ উইকেট। সেটা ছিল তার ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেকে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তিও আছে মিশুর। ২০১৬ সালের ওই ম্যাচে রংপুর বিভাগের বিপক্ষে তিনি প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেট শিকার করেছিলেন ৬৫ রানে।

Sharing is caring!