সাম্য ও শান্তির বার্তাবাহক

বাঙালির আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকা চির বিদ্রোহী আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেণী, তন্বী-নয়নে বহ্নি, আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম-উদ্দাম, আমি ধন্যি।’ তার কবিতায় একদিকে যেমন প্রেমের বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তেমনি সময়ের প্রয়োজনে গর্জে উঠেছিলেন বিদ্রোহের সুরে।

তাই নজরুলের জন্য ‘বিদ্রোহী কবি’ অভিধাটি যে অসঙ্গত হয়নি সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তিনি কেবল বিদ্রোহের জন্যই বিদ্রোহের কথা বলেননি, তার বিদ্রোহ যে কেবল পুরনোকে ভাঙার জন্য নয়, ছিল নতুনের সৃষ্টিও তার স্পষ্ট বার্তা ছিল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাতেই। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘আমি উপাড়ি ফেলিব অধীন বিশ্বে অবহেলে নবসৃষ্টির মহানন্দে।’ আবার বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য।’ আজ মঙ্গলবার সেই দ্রোহ ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকী। কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ, ইংরেজি ১৮৯৯ সালের ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান

জেলার আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। ছোটবেলায় তিনি পিতৃহারা হন। এরপর বাধার দুর্লঙ্ঘ্য পর্বত পাড়ি দিতে হয় তাকে। তবে বাংলার সাহিত্যাকাশে দোর্দ- প্রতাপে আত্মপ্রকাশ করেন কবি নজরুল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন- ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’

বাংলা সাহিত্যের গতিপথ পাল্টে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ধারা তৈরি করেন কাজী নজরুল। উচ্চ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন সাম্য আর মানবতা। ধ্যান-জ্ঞান, নিঃশ্বাস-বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনায় তিনি সম্প্রীতির কবি, অসাম্প্রদায়িক মেরুদ-। তার সাহিত্যকর্মে প্রাধান্য পেয়েছে ভালোবাসা, মুক্তি ও বিদ্রোহ। ধর্মীয় ভেদাভেদের প্রাচীর ভাঙারও ঘোষণা আসে তার কণ্ঠে।

ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও কবি হিসেবেই নজরুল বেশি পরিচিত। তবে বাংলা কাব্যে নজরুল এক নতুন ধারার জন্ম দেন ইসলামি সংগীত তথা গজল লিখে। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা ও সুর করেছেন, যা নজরুলগীতি হিসেবে পরিচিত। তার কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুলবাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরে আরও গান গ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়ই তাৎক্ষণিক লিখতেন। এ কারণে অনুমান করা হয়, প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া নজরুল গান রচনাকালে ১৯টি রাগের সৃষ্টি করেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তার রচিত ‘চল চল চল’ বাংলাদেশের রণসংগীত।

মধ্যবয়সে কবি পিক্স ডিজিজ নামে এক বিরল রোগে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। একসময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবিকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। ১৯৭৬ সালে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব এবং একুশে পদক দেওয়া হয়। ওই বছর ২৯ আগস্ট তিনি মারা যান।

করোনা দুর্যোগের কারণে কবির ১২২তম জন্মবার্ষিকীতে থাকছে না উন্মুক্ত কোনো আয়োজন। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আজ সকাল সাড়ে ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ কবির সমাধিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানাবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়সহ নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল একাডেমি, ছায়ানট ও শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন। রাত সাড়ে ৮টায় ভার্চুয়ালি প্রীতি সম্মিলনের আয়োজন করেছে আন্তর্জাতিক নজরুল চর্চাকেন্দ্র। রাত আটটায় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে থাকছে ‘শান্তির জয় হোক’ শিরোনামের বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান। বাংলাদেশ সংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদ তাদের নিজস্ব ফেসবুক পেজে প্রচার করবে কবির জন্মবার্ষিকীর বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান। এ ছাড়া জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করবে বিশেষ ক্রোড়পত্র। সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেল ও রেডিও স্টেশনগুলো প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

Sharing is caring!