লিটন এরশাদ,নিরাপদনিউজ : আজ ২৭ অক্টোবর ২০১৮, শনিবার সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে (৩য় তলা) প্রশিক্ষিত চালকদের মাঝে সনদ বিতরণ ও পরবর্তী নতুন ব্যাচের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ঘোষণা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । পাশাপাশি নিসচা প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের লন্ডন সফর ও ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ ২০১৮ এর মাসব্যাপী পালিত কর্মসূচির অগ্রিম সমাপ্তি ঘোষণাও করা হয় । তবে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সচেতনতামূলক কর্মসূচি চলমান থাকবে ।

উক্ত আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মাননীয় সচিব মোঃ নজরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)’র নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রাকিবুর রহমান ও টেকনোহেভেন গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ আমিনুল আহসান। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত থেকে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন সড়কে বিরাজমান বিভিন্ন বিষয়ের উপর গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন । অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নিসচা’র যুগ্ম মহাসচিব লিটন এরশাদ ।
পবিত্র কোরআন তেলওয়াত করেন আবু বক্কর সিদ্দিক রাব্বী, শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেন নিসচা সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম আজাদ হোসেন, স্বাগত বক্তব্য রাখেন নিসচা মহাসচিব সৈয়দ এহসান-উল হক কামাল ও সভাপতিত্ব করেন নিসচা ভাইস চেয়ারম্যান মো; রফিকুজ্জামান । আরও বক্তব্য রাখেন টেকনোহেভেন গ্রুপের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক জুনাইদুর রহমান মাহফুজ ও রোটারী ক্লাব অফ বারিধারা’র সাবেক সভাপতি রোটারিয়ান আহসানুল হক এফসিএ । অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে নিরাপদ সড়ক চাই ও টেকনোহেভেন গ্রুপ, মারাপকো ও জেট জেনারেটরের সহযোগিতায় আয়োজিত অনুষ্ঠানটির স্পন্সর প্রতিষ্ঠান জুবালী ব্রুস । মিডিয়া পার্টনার নিরাপদ নিউজ.কম ।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) দেশে শিক্ষিত চালক তৈরিতে ২০১০ সাল হতে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে । নিসচা ড্রাইভিং ও মেকানিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে দেশের এসএসসি পাশ বেকার দরিদ্র শ্রেনিকে বিনা ফিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ চালক তৈরি করে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত নিসচা নিজস্ব অর্থায়ন ও কিছু পৃষ্ঠপোষকের সহায়তায় ১০০০ চালক তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। প্রতি ৩ (তিন) মাস অন্তর অন্তর এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলে। এতে করে নিসচা যেমন দেশে শিক্ষিত চালক তৈরি করছে তেমনি দেশের দারিদ্র বিমোচনে ভূমিকা রেখে বেকার শ্রেনিকে কর্মক্ষম করে ভুমিকা রেখে চলেছে । আমাদের সাধ আছে সাধ্য নেই । যদি নিসচা পৃষ্ঠপোষকতা পায় তাহলে দেশে শিক্ষিত চালকের অভাব অনেকাংশে মিটবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তার বক্তব্যে ইলিয়াস কাঞ্চন পরিবহন শ্রমিক কর্তৃক অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার ব্যাপারে বলেন, কেউ আমাকে প্রতিপক্ষ মনে করলেও আমি কাউকে প্রতিপক্ষ মনে করি না । সবাইকে মিত্র ভাবি, বন্ধু ভাবি । আমি মনে করি সকলের সম্মিলিত উদ্যোগে সড়ককে নিরাপদ করা সম্ভব । কোথাও কোন সমস্যা দেখা দিলে তা আলোচনা করে সমাধান করা সম্ভব, প্রতিহিংসা দিয়ে নয় । আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে মহান আল্লাহকে স্মরণ করি সবসময় । কারও রক্তচক্ষুকে ভয় পাই না । ২৫ বছরে আমার উপর অনেক ঝড় এসেছে কিন্তু আমি থেমে যাইনি । আমার ছবিতে জুতার মালা, ছবি পোড়ানো, কুশপুত্তলিকা দাহ, প্রাণনাশের চেষ্টা অনেক কিছুই করা হয়েছে । ২৫ বছরেও আমি থেমে যাইনি, আর থামবোও না ।
তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনই আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে । সংবাদ পত্রের পাতায় রাজধানীর সড়কের ‘আজব’ চরিত্র দেখে । ‘আজব’ কথাটি বলছি অনেক বড় যন্ত্রনা থেকে । ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারা সড়কে নেমে দশদিনেই পাল্টে দিল পুরো বাংলাদেশ । সড়কে জরুরী লেন বলে যে কিছু থাকতে পারে তা তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে । সারিবদ্ধভাবে রিক্সা চলছে রাস্তায় । নির্দিষ্ট লেন মেনে গাড়ি চলছে, প্রতিটি মোড়ের একটু অদূরে গণপরিবহনগুলো থামছে সারিবদ্ধভাবে যাত্রী উঠানামা করছে, নেই কোন যানজট, জেব্রা ক্রসিং/ফুটওভার ব্রীজ দিয়ে পথচারী পারাপার হচ্ছে, ফুটপাত দিয়ে পথচারী চলাচল করছে, হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল চালকরা ক্ষমা প্রার্থনা করছে, কাগজপত্র বিহীন মালিক কিংবা চালকের লজ্জিত হওয়া- এ এক নতুন বাংলাদেশ আমরা দেখেছি ।
আগামী প্রজন্মের হাত ধরে এই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উচু করে দাঁড়াবেই । স্বপ্ন যখন বাস্তব হয়ে চোখের সামনে আশার আলো জেগেছিলা জাতির মনে । সম্ভাবনার আগামী দেখিয়ে বাচ্চারা ঘরে ফিরে গেল । কিন্ত এ কি আমি আবার কোন বাংলাদেশ দেখছি, কোন মানুষগুলোকে দেখছি, যে যার মতো রাস্তায় চলাচল করছে, গণপরিবহনগুলো ফিরে গেছে আগের রুপে- চরম এক বিশৃঙ্খলার ভুত চেপে বসল সড়কগুলোতে । তাহলে সে দশদিন কি আমরা স্বপ্ন দেখেছিলাম! আমি রাজপথে নামলাম, সড়কের মানুষগুলোর মাঝে কাজ করলাম । যানবাহনগুলোকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে ট্রাফিক আইন মেনে চলার অনুরোধসহ সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করলাম । ঘন্টা দুয়েকের বিশেষ এই ক্যাম্পেইনে বদলে গেল সড়কের চিত্র, বদলে গেলো সড়ক ব্যবহারকারীদের চরিত্র । দুটো ঘটনায় প্রমাণিত হলো আমরা আসলেই খামখেয়ালীভাবে সড়ক ব্যবহার করি । চাইলেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব । প্রশ্ন হচ্ছে ‘সম্ভব’- এর প্রতি আমরা কতটা আন্তরিক ।
প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতা খুললেই যে চিত্র চোখে পরে-যত্রতত্রভাবে পথচারী পারাপার হচ্ছে, ফুটপাত ভাসমান লোকের দখলে, মোড়ের মধ্যেই সড়কের অর্ধেকের বেশি দখল করে যাত্রী উঠানামা করছে, আইল্যান্ড টপকে কি পুরুষ, কি নারী, কি বাচ্চা রাস্তা পার হচ্ছে, নগরপরিবহনের অধিকাংশ দরজা খোলা, জানালার কাঁচ ভাঙ্গা, অনেক গাড়ির ফিটনেস নাই, গাড়ির দরজা ও বাম্পারে যাত্রী ঝুলে আছে, চলন্ত গাড়িতে দৌড়ে যাত্রী উঠছে এমন দৃশ্য এখন নিত্যকার । অভিজ্ঞতা বলে এই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন সমাজের সর্বস্তরে দীর্ঘমেয়াদী সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা ও আইনের কঠোর থেকে কঠোরতম প্রয়োগ । দীর্ঘদিনের চাওয়া পাওয়ার মধ্য দিয়ে পাশ হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ । এই আইন প্রণয়নে আমাদের ভূমিকা কারো অজানা নয় । বিশেষ করে আইনটির শিরোনাম নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল ব্যাপক । চেয়েছিলাম আইনটির শিরোনাম হোক ‘সড়ক পরিবহন ও সড়ক নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ । আমরা এখনও এ দাবী থেকে কিঞ্চিত বিচ্যুতও হইনি । সড়ক পরিবহন আইন যেটি পাশ হয়েছে এই আইনে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টির প্রতিফলন ঘটেনি । আমরা বলেছিলাম সড়ক দুর্ঘটনা নিরসন করতে হলে সড়কের নিরাপত্তার কথা প্রথমে আসে । সড়ক দুর্ঘটনার জন্য জেল জরিমানাতে সমাধান নয় দুর্ঘটনার কারণ জানার পরে তা লাঘবে প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ, ত্রুটি সংশোধন ও চালককে দক্ষ করে গড়ে তুলতে ইনস্টিটিউশনের বিকল্প নেই । এ জন্যে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগের । যার জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা ও বাজেটের- যা সড়ক নিরাপত্তার মাধ্যমেই সম্ভব । এখানে উল্লেখ্য যে সকল আইনেই শুধু শাস্তির বিধান থাকেনা সংশোধনেরও একটা উদ্যোগ থাকে । এমনকিছু অপরাধ আছে যা সংশোধনের মাধ্যমে সমাধান করা যায় । এমনিতেই আমাদের দেশে চালকের সংকট সেক্ষেত্রে শুধু শাস্তি দিলেই সমাধান হবেনা সংশোধনেরও ব্যবস্থা থাকতে হবে । এতে করে একজন চালককে মানসিকভাবে মানবিক চরিত্রের একজন হিসেবে গড়ে তোলা যেত । এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনায় শাস্তির মেয়াদ দশ বছর করা, অবৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং লাইসেন্সবিহীন ও ফিটনেসবিহীন গাড়ী চালিয়ে দুর্ঘটনা ঘটালে এবং তাতে কারো মৃত্যু হলে মামলা ৩০২ ধারায় হবে উল্লেখযোগ্য । তাছাড়া দুর্ঘটনার জন্য এককভাবে চালক কিংবা মালিক নয় যে দায়ী তাকেই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এককভাবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা যায়না । আইনটিতে আমাদের দাবীর কিছু কিছু বাস্তবায়ন হলেও শতভাগ সন্তুষ্ট হতে পারিনি । তবে আমি মনে করি পর্যায়ক্রমে সরকার এ আইন আরও যুগোপযোগী করে গড়ে তুলবেন । তারপরেও সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ প্রণয়নে সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এইজন্য যে, দীর্ঘদিনের জঞ্জাল পরিস্কার করে আইনটি প্রণয়ন করেছেন।
আজ থেকে ২৫ বছর আগে কেন এবং কি প্রেক্ষাপটে আমি নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন শুরু করেছিলাম তা কারও অজানা নয় । আমার স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর আমি যখন চলচ্চিত্র জগৎ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম তখন আমার কিছু শুভাকাংখীর পরামর্শে স্ত্রীকে ফিরে পাওয়ার জন্য নয় বরং এদেশের জনগণকে সড়কের মড়ক থেকে রক্ষার জন্য এই আন্দোলন গড়ে তুলি । দীর্ঘ এই পথ পরিক্রমায় এদেশের কোটি কোটি জনগণ আমাকে সমর্থন দিয়েছে, ভালবাসা দিয়েছে যার ফলাফল ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস এর স্বীকৃতি অর্জন । সেই সাথে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের রাজপথে নেমে আসা, দেশব্যাপী নিরাপদ সড়কের দাবীতে জনতার স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ, সমাজের সর্বস্তরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ঢেউ আমাদের ২৫ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শ্রমকে যৌক্তিক অবস্থানে উন্নীত করেছে । ১৭ কোটি মানুষের প্রাণের আকুতি নিরাপদ সড়ক চাই । আমাদের গঠনমূলক ও কার্যকর কর্মসূচি- জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে দেশের সর্বত্র সভা, সমাবেশ ও র‍্যালী, বিদ্যমান চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা, দেশের সকল বাস টার্মিনালসমূহে চালক ও যাত্রীদের মাঝে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষিত করে তোলা, অভিভাবকদের মাঝে সড়ক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা, তৃণমূল পর্যায় থেকে আগামী প্রজন্মকে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের (পিটিআই-এর মাধ্যমে) প্রশিক্ষণ প্রদান ইত্যাদি ।
এবার আসি সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে । ২৫ বছর পূর্বে এদেশের জনসংখ্যা ছিল ১১ কোটি, গাড়ী ও সড়কের সংখ্যা ছিল অনেক কম কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের পরিমাণ ছিল অনেক বেশী । তখন সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা প্রতিবছর গড়ে ১০,০০০/১২,০০০ এর উপর ছিল । আহতের সংখ্যা ছিল গড়ে ২৫,০০০/৩০,০০০ । আজ দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি, রেজিস্ট্রেশনকৃত গাড়ির সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখ । তবে আনরেজিস্টার্ড গাড়ী তথা নসিমন, করিমন, ইজিবাইক, ভটভটি, মোটরসাইকেল মিলিয়ে এসংখ্যা হবে প্রায় ৬০ লাখ । সড়কের পরিধি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে সে তুলনায় সড়ক দুর্ঘটনা, নিহত ও আহতের সংখ্যা অনেকাংশে কমে এসেছিলো । ২০১৫ সালে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমান ছিল ২৬২৬ টি ও নিহতের সংখ্যা ছিল ৫০০৩ জন, আহতের সংখ্যা ৬১৯৭ । ২০১৬ সালে আমাদের পরিসংখ্যানে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমান ছিল ২৩১৬ টি ও নিহতের সংখ্যা ছিল ৪১৪৪ জন, আহতের সংখ্যা ৫২২৫ । আমাদের আন্দোলনের ফলে সকলের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে বিধায় এ সুফল পাওয়া গিয়েছিলো। তবে কাংখিত সচেতনতা এখনও তৈরী হয়নি বলে আমরা মনে করি । তাই দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় গত বছর ২০১৭ সালে এসে সড়ক দুর্ঘটনার হার বেড়ে যাওয়ায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায় । তখন দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়ে হয় ৩৩৪৯ । এতে আহত হয় ৭৯০৮ জন এবং নিহত হয় ৫৬৪৫ জন ।
হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া দুর্ঘটনার কারন অনুসন্ধানে যে তথ্য উঠে এসেছে তাতে আমরা শংকিত চমকে উঠতে হয় সড়ক দুর্ঘটনার সম্পর্কৃত কারণ জেনে । ২০১৬ সালে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল ৭ লক্ষ যা এখন বেড়ে ২২ লক্ষ । অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোর মোটরসাইকেল চালকগণ অতিরিক্ত গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার স্বীকার হন এবং ক্রমেই তা বেড়ে চলেছে । পাশাপাশি মহাসড়কসহ দেশের বিভিন্ন সড়কসমুহে হঠাৎ গজে ওঠা ইজিবাইক, ভটভটি, নসিমন, করিমনের দৌরাত্মে সড়ক নিরাপত্তা পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ বাহনের সংখ্যা ব্যাঙের ছাতার মতো ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও সড়ক মহাসড়কে তাদের অবাধ চলাচল থামছেই না। ফলশ্রুতিতে সড়ক দুর্ঘটনার লাগাম কোনভাবেই টেনে ধরা যাচ্ছে না। ২০১৭ সালের দুর্ঘটনায় নিহতের ২৭ ভাগই মোটরসাইকেল আরোহী । শুধুমাত্র এ বছরের আগষ্ট ও সেপ্টেম্বরে ঢাকা শহরের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৫ জনের মধ্যে ৭ জনই ছিল মোটরসাইকেল আরোহী । তাছাড়াও অদক্ষ চালক (শুধুমাত্র বাস-ট্রাকই নয় এখানে অদক্ষ চালক বলতে সি.এন.জি, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, ভটভটি, নসিমন, করিমন ইত্যাদি চালকরাও রয়েছে) ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, মালিকের অব্যবস্থাপনা, মনিটরিংয়ের অভাব, দূর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, জনগণের অসচেতনতা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ক্রটি, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইন ও তার যথারীতি প্রয়োগ ইত্যাদিই উঠে আসে । আর এসব থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে শুধু আমার হৃদয়ে নয়, পুরো জাতির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে না ।
২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস । এবারের জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘আইন মেনে চলবো, নিরাপদ সড়ক গড়বো’ । তবে আমরা শুধু একদিনে দিবসটি উদযাপন করবো না বরং সারা বছর আমরা বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে চালক, মালিক, পথচারি, যাত্রী, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমজীবী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ড অব্যাহত রাখবো এবং দেশবাসিকে সচেতন করার মাধ্যমে দেশকে সড়ক দুর্ঘটনার মহামারী থেকে উদ্ধার করবো ইনশাআল্লাহ ।
গত ১অক্টোবর ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ উপলক্ষে নিসচা মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল এবং তা যথারীতি পালন করা হচ্ছে । দেশব্যাপী নিসচা’র ১২০ টি শাখা সংগঠনও অনুরূপ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে । এবার নিরাপদ সড়ক দিবসে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন পরিচালনা, রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা, টাঙ্গাইল–বগুড়া–নাটোরে পিটিআই’র মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা, টাঙ্গাইল ও টঙ্গীবাড়ীতে চালক প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালনা, প্রায় প্রতিদিনই সচেতনতামূলক ডিজিটাল ক্যাম্পেইন, বিষয়ভিত্তিক সংবাদ সম্মেলন, বিষয়ভিত্তিক টকশোতে অংশগ্রহণ, র‍্যালী ও সমাবেশ, লিফলেট-পোষ্টার-ব্যানার-ফেষ্টুন প্রচার, মরহুমা জাহানারা কাঞ্চনের কবর জিয়ারত ও তাঁর স্মরণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং কেন্দ্রীয় কর্মসূচির আলোকে ১২০ টি শাখা সংগঠনের মাধ্যমে সারা দেশে ও বিদেশে অনুরূপ কর্মসূচি পরিচালনা – মোট ৩০০ (তিনশত) কর্মসূচি পরিচালনা করা হয় । পাশাপাশি নিসচা আরও জানাচ্ছে এসব কর্মসূচি সারা বছরই চলমান থাকবে । উল্লেখ্য গত বছরের ২২ অক্টোবর হতে এ বছরের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ১২০০ (বারশত) কর্মসূচি পালন করেছে । নিসচা নিজ অর্থায়নে ও কিছু শুভাকাঙ্ক্ষীর সহযোগিতা এবং শাখা সংগঠনগুলোর সহায়তায় এসব কর্মসূচি পরিচালনা হয়ে থাকে এবং হচ্ছে ।
আমরা বলতে চাই সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে বর্তমান সরকারের আন্তরিকতা ও তাৎক্ষণিক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ চোখে পড়ার মত। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সড়ক দুর্ঘটনা নিরসনে যে ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন তা বাস্তবায়নে সরকারের প্রতিটি সংস্থা তৎপর রয়েছে । পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনারোধে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়ে সেধরনের কর্মসূচিতে আরও বেশি করে উদ্যোগী হয়েছে।
নিসচা’র গবেষণায় গত তিন বছর ও চলতি বছর এসে সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যায় দেখা যায় যে, পথচারী ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এবছরের শুরু থেকে তৃণমূল পর্যায় থেকে আগামী প্রজন্মকে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিটিআই (প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট)-এর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রদানের কার্যক্রম শুরু করে।পাবনা পিটিআই’র মাধ্যমে নতুন এ কর্মসুচির সূচনা করা হয়। এ পর্যন্ত ১৬টি জেলার পিটিআই’র কর্মশালা পরিচালনা করা হয়েছে। দেশের সরকারী ও বেসরকারী মিলিয়ে ৬৮টি পিটিআই-তে প্রতিবছর এ কর্মসূচি চলমান থাকবে। উল্লেখ্য প্রতিটি পিটিআই-তে ২০০ এর অধিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকেন। এই হিসেবে ৬৮ টি পিটিআই-তে প্রতিবছর ৬৮ X ২০০ = ১৩,৬০০ শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে থাকে। এসব শিক্ষকদেরই সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে প্রশিক্ষিত করার টার্গেট নিয়ে নিসচা নতুন এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। নিসচা মনে করে প্রশিক্ষিত শিক্ষকরা যদি শ্রেণি শিক্ষার কার্যক্রমের পাশাপাশি সড়ক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন, অভিভাবক সমাবেশের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সচেতন করেন, যার যার এলাকার জনপ্রতিনিধি বিশেষ করে ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সড়ক নিরাপত্তার কর্মসূচি পরিচালনায় উদ্বুদ্ধ করেন তাহলে তৃণমূল পর্যায় থেকে সড়ক ব্যবহারে সচেতনতা তৈরী হবে।
এই ধারাবাহিকতায় আগামী পাঁচ বছর কর্মসুচি পরিচালনার প্রথম পর্যায়ে টার্গেট নিয়ে নিসচা কর্মপরিকল্পনা তৈরী করেছে। এতে করে আগামী পাঁচ বছরে ১৩,৬০০ X ৫ = ৬৮,০০০ শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা যাবে। বলাবাহুল্য জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি গোল অর্জনে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে তা নিয়ে এক ধরনের শংকা দেখা দিয়েছে। আমরা আশাবাদী হতে চাই- এখনও সম্ভব যদি বাকী আড়াই বছরে আমরা যদি ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরী করতে পারি তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসতে বাধ্য।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন,এহসান-উল হক কামাল- মহাসচিব, লিটন এরশাদ- যুগ্ম মহাসচিব,বেলায়েত হোসেন খান (নান্টু)- যুগ্ম মহাসচিব,মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক রাব্বী- দুর্ঘটনা ও অনুসন্ধান বিষয়ক সহ-সম্পাদক,ফিরোজ আলম মিলন- কার্যকরী সদস্য, নজরুল ইসলাম ফয়সাল- কার্যকরী সদস্য, আসাদুর রহমান- কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য, ফিরোজ এম হাসান- কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য, মোঃ ওয়ারেছ আলী- কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য, মোঃ বিজয়- কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য, মোছাঃ শিউলী – কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য, মোঃ নুরে আলম- কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য, মোঃ দেলোয়ার হোসেন- কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য, মোঃ আবুল হোসেন- কেন্দ্রীয় সাধারন সদস্য।

Sharing is caring!