ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদের একটি বাজারে একটি কাঠের একটি ছোট দোকান আছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কমলাবেন অশোকভাই পাতনির। সেখানে পিতল, সিটি গোল্ড এবং বিভিন্ন ধাতু ও প্লাস্টিকের অলঙ্কার বিক্রি করেন তিনি।

বড় ব্যবসায়ীদের তুলনায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বরাবরই অনেক বেশি ঝুঁকি-চ্যালেঞ্জ নিতে হয়, কমলাবেনও তার ব্যতিক্রম নন। তবে তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো আবহওয়াগত পরিস্থিতি। আরও স্পষ্টভাবে বললে গুজরাটের দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল ও সে সময়কার প্রখর সূর্যের উত্তপ্ত দিনগুলো তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

কারণ, অতিরিক্ত তাপ ও গরমে পিতলের গয়নাগুলো ঔজ্জল্য হারিয়ে কালো হয়ে যায়, সিটিগোল্ড বা ইমিটেশনের তৈরি অলঙ্কারের নকল মুক্তাগুলো আঠা খুলে পড়তে থাকে।

এপ্রিল থেকেই তাপ বাড়তে শুরু করে আহমেদাবাদে। এই মাসের শেষ দিকে গুজরাটের রাজধানীর গড় তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তারও বেশি ওঠে। ২০১৬ সালের গ্রীষ্মে আহমদাবাদের তাপমাত্রা উঠেছিল রেকর্ড ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। গত বছর গ্রীষ্মে বেশ কিছুদিন আহমেদাবাদের তাপমাত্রা ৪৬ ডিগ্রি বা তার আশপাশে থেকেছে।

‘অতিরিক্ত তাপমাত্রায় অলঙ্কারগুলোর রং জ্বলে যেতে থাকে এবং একসময় সেগুলো আবর্জনায় পরিণত হয়,’ রয়টার্সকে বলছিলেন ৫৬ বছর বয়সী কমলাবেন। সংসারে চার জন সন্তান রয়েছে তার এবং গোটা পরিবার তার আয়ের ওপর নির্ভরশীল।

তবে চলতি বছরের গ্রীষ্মে তিনি খানিকটা হলেও দুশ্চিন্তামুক্ত। কারণ, গুজরাটের রাজ্য সরকার কিছুদিন আগে মাঝারি ও ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য ‘তাপ বিমা’ নামের একটি সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে এবং ইতোমধ্যে এই বিমা সুবিধা গ্রহণের জন্য নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছেন গুজরাটের প্রায় ২১ হাজার নারী উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী।

এই প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী, গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা যদি স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি ওঠে এবং তা যদি ৩ দিন স্থায়ী হয়, সেক্ষেত্রে বিমাকারীরা কিছু পরিমাণে আর্থিক সহায়তা পাবেন।

অর্থনীতির ভাষায় এ ধরনের বিমাকে বলা হয় ‘প্যারামেট্রিক বিমা’। এমনিতে সাধারণ বিমার ক্ষেত্রে বিমার আর্থিক সুবিধা পেতে হলে যার বা যে জিনিসের ওপর বিমা করা হয়েছে— সেই ব্যক্তি বা বিমাকৃত সেই জিনিসের ক্ষয়ক্ষতির সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতে হয়; কিন্তু প্যারামেট্রিক বিমার ক্ষেত্রে এই সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বজুড়ে অকল্পনীয় গতিতে বাড়ছে দীর্ঘমেয়াদী তাপপ্রবাহ, খরা, ঝড়, অতিবৃষ্টি, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ; আর এসবের সরাসরি শিকার হচ্ছেন সমাজের মাঝারি ও প্রান্তিক পর্যায়ের পেশাজীবীরা। গত কয়েক বছর ধরে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি মাঝারি ও নিম্ন আয়ের মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে।

সমাজের এই স্থরের লোকজনদের দুর্যোগকালীন আর্থিক সহায়তা দিতে তাই সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চালু হচ্ছে এই প্যারামেট্রিক বিমা সুবিধা।

সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইউরোপীয় বীমা কোম্পানি সুইস আরই তাদেরদ সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক বছরে ইউরোপে এই বিমা সুবিধা গ্রহণের জন্য নাম নথিভূক্তের হার বেড়েছে ৪০ শতাংশ। বিমার আন্তর্জাতিক বাজার পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা অ্যালাইড মার্কেট রিসার্চ এস্টিমেটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্যারামেট্রিক বিমা খাতের আয়তন ছিল ১ হাজার ১৭০ কোটি ডলার এবং ২০৩১ সালের মধ্যে এর আয়তন পৌঁছাবে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারে।

বিমা বাণিজ্য বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্টের মহাসচিব এখোসুয়েহি ইয়াহেনও সম্প্রতি বলেছেন, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিনই বাড়ছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্যারামেট্রিক বিমার আওতায় আসতে থাকা মানুষের সংখ্যা।

গত কয়েক বছরে লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের অনেক দেশে এই বিমা প্রকল্প শুরু হয়েছে, বিমার জন্য নিবন্ধিত লোকজনের হারও বাড়ছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ভারত

চলতি বছর থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ভারতে শুরু হয়েছে এই প্যারামেট্রিক বিমা প্রকল্প, যা সাধারণভাবে পরিচিতি পেয়েছে ‘তাপ বিমা’ নামে। আরশত-রক ফাউন্ডেশন রিসাইলেন্স সেন্টার নামের একটি অলাভজন একনজিও সংস্থা, মাইক্রো ইনস্যুরেন্স স্টার্ট আপ সংস্থা ব্লু মার্বেল, আইসিআইসি ব্যাংক ও একটি ট্রেড ইউনিয়নের যৌথ পরিচালনায় প্রাথমিক ভাবে গুজরাটের রাজধানী আহমেদাবাদে এই প্রকল্প চালু করেছে। পরে দেশের অন্যান্য রাজ্যেও এই বিমা ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে প্রকল্প পরিচালকদের।

আরশত-রক ফাউন্ডেশনের পরিচালক ক্যাথি বাগম্যান ম্যাকলেওড রয়টার্সকে বলেন, ‘এই বিমার সবচেয়ে সুন্দর দিকটি হলো— এটা খুবই সহজ এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এর সুবিধা পাওয়া যায়।’

‘প্রকল্পটি পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা এখনও সেবামূলক নীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছি। ব্যবসায়ীকভিত্তিতে এখনও এটি খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেসব ঝুঁকি কেটে যাবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।’

আহমেদাবাদের তাপমাত্রা এখনও ৪৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়নি, তবে ছাড়িয়ে গেলে বিমার আর্থিক সুবিধা পাবেন কমলাবেন অশোভাই পাতনি। কী করবেন সেই টাকা দিয়ে?

রয়টার্সের িএ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রথমেই তাপজনিত কারণে মাথা ব্যাথার ওষুধ কিনবেন তিনি।

‘আমাকে প্রতিদিন ১৫ ঘণ্টা এই দোকানে বসে থাকতে হয়। গরমের দিনে টানা ১৫ ঘণ্টা এখানে বসে থাকা খুবই কষ্টের’, রয়টার্সকে বলেন কমলাবেন।

Sharing is caring!